আমরা সবাই তরঙ্গ দেখেছি, একটা পানিতে ঢিল ছুড়ে দিলে সেই বিন্দু থেকে পানির তরঙ্গ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ঘরে বাতি জ্বালালে যে আলো ঘরে ছড়িয়ে পড়ে সেটাও তরঙ্গ। আমরা যখন কথা বলি আর শব্দটা যখন এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পৌঁছে যায় সেটাও তরঙ্গ। একটা স্প্রিংকে সংকুচিত করে ছেড়ে দিলে তার ভেতর দিয়ে যে বিচ্যুতিটি ছুটে যায় সেটাও তরঙ্গ, একটা টান করে রাখা দড়ির মাঝে ঝাঁকুনি দিলে যে বিচ্যুতিটি দড়ি দিয়ে ছুটে যায় সেটাও তরঙ্গ। এক কথায় বলা যায় তরঙ্গটি কী আমরা সেটা অনুভব করতে পারি, কিন্তু যদি তার জন্য পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় একটা সুন্দর সংজ্ঞা দিতে চাই তাহলে কী বলব?
সহজ ভাষায় বলা যায়, তরঙ্গ হচ্ছে একটা মাধ্যমের ভেতর দিয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় শক্তি পাঠানোর একটা প্রক্রিয়া, যেখানে মাধ্যমের কণাগুলো তার নিজের অবস্থানে স্পন্দিত হতে পারে কিন্তু সেখান থেকে সম্পূর্ণ সরে যাবে না।
আমরা এবারে যাচাই করে দেখতে পারি আমাদের এই সংজ্ঞাটি আমাদের অভিজ্ঞতার সাথে মেলে কি না। নদীর মাঝখান দিয়ে একটা লঞ্চ যাবার সময় যে ঢেউ তৈরি করে সেই ঢেউ নদীর কূলে এসে আঘাত করে, কাজেই নিশ্চিতভাবে বলা যায় এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় শক্তি পাঠানো হয়েছে। সেই সময়ে নদীর পানিতে ভাসমান কোনো কচুরিপানার দিকে তাকালে আমরা দেখব যখন ঢেউটি যাচ্ছে সেই মুহূর্তে কচুরিপানাটি উপরে উঠেছে এবং নিচে নেমেছে এবং ঢেউ চলে যাবার পর আবার আগের মতো স্থির হয়ে গেছে এবং মোটেও ঢেউয়ের সাথে সাথে তীরে এসে আছড়ে পড়েনি।
সরল স্পন্দন গতির সাথে তরঙ্গের সম্পর্কটা এখন নিশ্চয়ই তোমরা বুঝতে পারছ। একটা মাধ্যমের কোনো একটা নির্দিষ্ট বিন্দুর দিকে যদি আমরা তাকিয়ে থাকি তাহলে যখন তার ভেতর দিয়ে একটা তরঙ্গ যেতে থাকে তখন সেই বিন্দুটির সরল স্পন্দন গতি হয়। কচুরিপানার বেলায় যেটা ঘটেছিল, যতক্ষণ তার ভেতর দিয়ে পানির তরঙ্গটা গিয়েছে ততক্ষণ সেখানে সরল স্পন্দন গতি হয়েছে। সরল স্পন্দন গতির মাঝে তরঙ্গ নেই, কিন্তু তরঙ্গের প্রত্যেকটা বিন্দু একেকটা সরল স্পন্দন গতি।
কাজেই তরঙ্গের জন্য আমাদের দেওয়া সংজ্ঞাটি সঠিক। তবে মনে রাখতে হবে আরো অনেক ধরনের তরঙ্গ আছে যার জন্য এই সংজ্ঞাটি পুরোপুরি সঠিক নাও হতে পারে। আমরা তরঙ্গে যাবার জন্য একটা মাধ্যমের কথা বলেছি কিন্তু সূর্য থেকে আলো যখন পৃথিবীতে পৌঁছায় তখন তার জন্য কোনো মাধ্যমের প্রয়োজন হয় না। আলো হচ্ছে বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ। সেটা নিয়ে নবম অধ্যায়ে আমরা আলোচনা করব। গ্র্যাভিটি ওয়েভ নামে এক ধরনের তরঙ্গের কথা বিজ্ঞানীরা বলছেন, যেটি মাত্র কিছুদিন হলো বিজ্ঞানীরা প্রথমবার দেখতে পেয়েছেন। তার জন্যও কোনো মাধ্যমের প্রয়োজন নেই। পদার্থবিজ্ঞানের চমকপ্রদ শাখা কোয়ান্টাম মেকানিক্সে ওয়েভ ফাংশন বলে অন্য এক ধরনের তরঙ্গের কথা বলা হয় সেটি আরো বিচিত্র, সেখানে সরাসরি তরঙ্গটি দেখা যায় না শুধু তার প্রতিক্রিয়া অনুভব করা যায়।
কাজেই আমরা আপাতত আমাদের আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখব শুধু সেই সব তরঙ্গের মাঝে যার জন্য কঠিন, তরল বা গ্যাসের মতো মাধ্যমের দরকার হয়। এই ধরনের তরঙ্গের নাম যান্ত্রিক তরঙ্গ।
তরঙ্গ নিয়ে আলোচনা করার সময় তার কয়েক ধরনের বৈশিষ্ট্যের কথা উঠে এসেছে, এখানে আমরা তরঙ্গের, বিশেষ করে যান্ত্রিক তরঙ্গের সব বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করব।
(i) যান্ত্রিক তরঙ্গের জন্য মাধ্যমের দরকার হয়। পানিতে ঢেউ হয়, একটা স্প্রিংয়ে তরঙ্গ পাঠানো যায়, একটা দড়িতে তরঙ্গ সৃষ্টি করা যায়। আমরা যে শব্দ শুনি সেটাও একটা তরঙ্গ এবং তার মাধ্যম হচ্ছে বাতাস।
(ii) একটা মাধ্যমের ভেতর দিয়ে যখন তরঙ্গ যেতে থাকে তখন কণাগুলো নিজ অবস্থানে থেকে স্পন্দিত হয় (কাঁপে কিংবা ওপর-নিচে যায়) কিন্তু কণাগুলো নিজে তরঙ্গের সাথে সাথে সরে যায় না।
( iii) তরঙ্গের ভেতর দিয়ে শক্তি এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে পারে। শক্তি যত বেশি হয় তরঙ্গের বিস্তার তত বেশি হয়। শক্তি তরঙ্গের বিস্তারের বর্গের সমানুপাতিক। অর্থাৎ বিস্তার বদি দ্বিগুণ হয় শক্তি হয় চার গুণ।
(iv) সব তরঙ্গেই একটা বেগ থাকে সেই বেগ তার মাধ্যমের প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে। বাতাসে শব্দের বেগ 330 m/s পানিতে এই বেগ 1493m/s। ঢিলে একটা দড়িতে একটা তরঙ্গের যত বেগ হবে টান টান করে রাখা দড়িতে হবে তার থেকে বেশি।
(v) তরঙ্গের প্রতিফলন কিংবা প্রতিসরণ হয়, পরের অধ্যায়ে আলোর জন্য এটি অনেক বড় করে আলোচনা করা হয়েছে। আপাতত জেনে রাখ এক মাধ্যম থেকে অন্য মাধ্যমে যাবার সময় তরঙ্গের খানিকটা যদি প্রথম মাধ্যমে ফিরে আসে সেটা হচ্ছে প্রতিফলন।তরঙ্গ যখন প্রথম মাধ্যম থেকে দ্বিতীয় মাধ্যমে যায় সেটা হচ্ছে প্রতিসরণ। আমরা যখন শব্দের প্রতিধ্বনি শুনি সেটা হচ্ছে শব্দের প্রতিফলন। পানিতে ডুবে থাকা অবস্থায় যদি বাইরের শব্দ শুনি সেটা হচ্ছে প্রতিসরণ।
(vi) তরঙ্গের যতগুলো বৈশিষ্ট্য আছে, তার মাঝে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে উপরিপাতন, যদিও আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সেটা আমাদের খুব বেশি চোখে পড়ে না। ধরা যাক দুটি ভিন্ন ভিন্ন জায়গা থেকে এক জায়গার দুটি তরঙ্গ এসে হাজির হয়েছে। একটি তরঙ্গ যখন মাধ্যমটিকে উপরে তুলতে চেষ্টা করছে অন্যটি তখন তাকে নামানোর চেষ্টা করছে, তখন কী হবে? এগুলো হচ্ছে উপরিপাতনের বিষয়, যখন তরঙ্গের আরো গভীরে যাবে তখন বিষয়গুলো আরো ভালোভাবে জেনে যাবেদুটো তরঙ্গ একটি আরেকটিকে বড় করে দিতে পারে আবার একটি আরেকটিকে ধ্বংসও করে দিতে পারে।
একটা স্প্রিংয়ের ভেতর দিয়ে একটা তরঙ্গ যাবার সময় তরলটি স্প্রিংকে সংকুচিত এবং প্রসারিত করে এগিয়ে যায়। আবার একটা দড়ির এক প্রান্তে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে একটা ভরণ তৈরি করে দড়ির মাঝে দিয়ে পাঠানো যার। দুটি তরঙ্গের মাঝে কিন্তু একটা মৌলিক পার্থক্য আছে। স্প্রিংয়ে তরঙ্গ হল সংকোচন এবং প্রসারণের, স্প্রিংটির সংকোচন এবং প্রসারণের দিক এবং তরঙ্গের বেগ একই দিকে। এই ধরনের তরঙ্গের নাম অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ। শব্দ হচ্ছে এ রকম অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ (Longitudinal wave)।
দড়ির বেলায় আমরা যখন দড়িটিতে ঝাঁকুনি দিয়ে তরঙ্গ তৈরি করেছি সেখানে দড়ির কম্পনটি কিন্তু তরঙ্গের বেগের দিকে ঘটে না। কম্পনের দিক অর্থাৎ দড়ির ওঠা এবং নামা, তরঙ্গের বেগের সাথে লম্ব। এরকম তরঙ্গের নাম অনুপ্রস্থ তরঙ্গ (Transverse wave)। পানির ঢেউ হচ্ছে এর একটি উদাহরণ।
সরল স্পন্দন গতিতে আমরা যে সকল রাশির কথা বলেছি তার সবগুলোই আসলে তরঙ্গের বেলা ব্যবহার করতে পারব। একটা তরঙ্গেরও পূর্ণ স্পন্দন হয়, তার পর্যায়কাল আছে, কম্পাঙ্ক আছে এবং বিস্তার আছে। আমরা দেখেছি কোনো একটা তরঙ্গ যাবার সময় আমরা যদি মাধ্যমের কোনো একটা কণার দিকে তাকিয়ে থাকি তাহলে দেখব সেই কণাটির সরল স্পন্দিত কম্পন হচ্ছে। তরঙ্গের বেলায় আমরা নতুন দুটি রাশির কথা বলতে পারি যার একটা হচ্ছে তরঙ্গ দৈর্ঘ্য। তরঙ্গের যেকোনো একটি দশা থেকে তার পরবর্তী একই দশার মাঝে দুরত্ব হচ্ছে তরঙ্গ দৈর্ঘ্য।অর্থাৎ এক পর্যায়কালে একটা তরঙ্গ যেটুকু দূরত্ব অতিক্রম করে সেটাই হচ্ছে তরঙ্গ দৈর্ঘ্য।
তরঙ্গের মাঝে দ্বিতীয় আরো একটি রাশি রয়েছে যেটা সরল স্পন্দিত কম্পনে নেই, সেটি হচ্ছে তরঙ্গের বেগ। প্রতি সেকেন্ডে একট তরঙ্গ যেটুকু দূরত্ব অতিক্রম করে সেটাই হচ্ছে তরঙ্গের বেগ । প্রতি সেকেন্ডে যে কয়টি পর্যায়কাল থাকে সেটি হচ্ছে কম্পাঙ্ক, কম্পাঙ্ক যদি f এবং তরঙ্গ দৈর্ঘ্য 𝜆 যদি হয় তাহলে বেগ হচ্ছে
একটা তরঙ্গ যখন একটা মাধ্যম থেকে অন্য মাধ্যমে যার তখন তার বেগের পরিবর্তন হয়, যেহেতু কম্পাঙ্ক সব সময় সমান থাকে তাই তরঙ্গ যখন এক মাধ্যম থেকে অন্য মাধ্যমে যায় তখন তার তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের পরিবর্তন হয়। অর্থাৎ তরুণ বিভিন্ন মাধ্যমের ভেতর দিয়ে যাবার সময় তার তরঙ্গ দৈর্ঘ্য কিংবা বেগের পরিবর্তন হয় কিছু কম্পাঙ্কের বা পর্যায়কালের কখনো পরিবর্তন হয় না।